• SHUVECHCHHA PREPARATORY SCHOOL - Slide
মেনু নির্বাচন করুন

জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২০


জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২০

 

সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সামগ্রিক শিক্ষাক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা করেছে। এই পরিকল্পনার আওতায় বিষয়, পাঠ্যবই, পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি, পাবলিক পরীক্ষা, সময় ও ছুটি প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিস্তর পরিবর্তনের আয়োজন করা হয়েছে যা ২০২২ সাল থেকে প্রাথমিকের প্রাক-প্রাথমিক, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে; মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে এবং ধারাবাহিকভাবে পরবর্তী শ্রেণিগুলোতে কার্যকর করা হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণির আগে শিক্ষার্থীদের কোনো পাবলিক পরীক্ষায় বসতে হবে না বলা হয়েছে। এতে পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা নিয়ে বিদ্যমান সমালোচনার অবসান হবে; বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার পরীক্ষাকেন্দ্রিকতা ও শিশুদের পরীক্ষার্থী হিসেবে গড়ে তোলার প্রবণতা কমবে বলে আশা করা যায়। সে বিবেচনায় এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়েছে।

চলমান পদ্ধতিতে নবম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান, মানবিক বা বাণিজ্য বিভাগের যেকোনো একটি বাছাই করতে হয়। বয়স ও অভিজ্ঞতাজনিত কারণে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই অনেকটা না বুঝে বিভাগ বাছাই করে। পরবর্তী সময়ে তাদের আবার বিভাগ পরিবর্তনের সুযোগও সীমিত। নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় শিক্ষার্থীদের বিভাগ পরিবর্তন নবম শ্রেণির পরিবর্তে একাদশে হবে বলা হয়েছে। সে অনুসারে শিক্ষার্থীরা আরেকটু সময় পাওয়ার কারণে বিভাগ বাছাইয়ে আরেকটু পরিপক্ব সিদ্ধান্ত নিতে পারবে বলে মনে হয়। এছাড়া দশম শ্রেণি পর্যন্ত একই বিষয় শেখানোর সুযোগ থাকলে সব শিক্ষার্থীকে প্রয়োজনীয় সব মৌলিক বিষয় সম্পর্কে জানানো যাবে। শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় দশটি মূল শিখনক্ষেত্র নির্ধারণ করা হয়েছে যার ওপর ভিত্তি করে বিষয় ও পাঠ্যবইয়েও বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। শিখনক্ষেত্র নির্ধারণেও নতুনত্ব চোখে পড়েছে; সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, স্বাস্থ্য-সুরক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি ও মূল্যবোধ-নৈতিকতার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বৈশ্বিক ও চলমান অবস্থা বিচারে এসব বিষয় সংযোজনের দরকার ছিল। সব শ্রেণিতে পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা কমবে এটিও আশাব্যঞ্জক খবর।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মুখস্থ নির্ভরতা কমানোর উদ্দেশ্যে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। ব্লুমস-ট্যাক্সোনমি অনুসরণে সৃজনশীল পদ্ধতি তৈরি করা হয়েছিল।  তারপরও প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় জ্ঞানমূলক (নলেজ) দক্ষতা অর্জনই সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে, দক্ষতা (স্কিল) বিশেষ করে মূল্যবোধের (অ্যাটিচিউড) ক্ষেত্রগুলো এখনো উপেক্ষিত। নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতার পাশাপাশি মূল্যবোধ ও গুণাবলির ওপর সমান গুরুত্ব আরোপ করার কথা বলা হয়েছে। এটিও ভালো পরিকল্পনা, এতে শিখনের তিনটি ক্ষেত্র জ্ঞান, দক্ষতা ও মূল্যবোধ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের শেখার ও উন্নয়নের সুযোগ থাকবে। শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় মূল্যবোধ ও গুণাবলিকে আলাদা দুটি ক্ষেত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে যেটার কারণ স্পষ্ট হয়নি। এ দুটো ক্ষেত্রকে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা নামে একটি ক্ষেত্র হিসেবেই রাখা যায়। শিক্ষাক্রমের রূপরেখা ২০২০-এ আরও কিছু নতুন ও প্রয়োজনীয় বিষয় সংযোজনের প্রস্তাব রয়েছে। যেমন, একীভূত ও বৈচিত্র্যময় শিখন পরিবেশ, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা, নমনীয় শিক্ষাক্রম, প্রয়োগমূলক শিক্ষা এবং প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশের বাইরেও শেখার সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানের নাগরিক তৈরি প্রভৃতি।

সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনার প্রস্তাব রয়েছে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে; প্রচলিত পদ্ধতিতে যেখানে বছর শেষের চূড়ান্ত মূল্যায়ন সর্বাধিক গুরুত্ব পায় নতুন শিক্ষাক্রমে শিখনকালীন মূল্যায়নের ওপর সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।  তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সম্পূর্ণ শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে, পরবর্তী শ্রেণিগুলোতে আস্তে আস্তে সামষ্টিক বা চূড়ান্ত মূল্যায়নের পরিমাণ বাড়বে। তবে দশম শ্রেণিতেও শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৫০% এবং একাদশ-দ্বাদশে ৩০%। শিখনকালীন মূল্যায়নের সুবিধা অনেক; শিক্ষার্থীদের ফিডব্যাক পেয়ে উন্নয়নের সুযোগ অনেক বেশি থাকে, পরীক্ষাভীতি কমে- যার জন্য শিখন ভালো হয়। শিখনকালীন মূল্যায়নে স্কুল এবং শিক্ষকদের ভূমিকাই প্রধান। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, আমাদের শিক্ষক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ ধরনের পরিবর্তিত ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে কতটুকু প্রস্তুত? ২০২২ সাল থেকে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে একসঙ্গে পুরনো ও নতুন মিলিয়ে দুটি শিক্ষাক্রম পাশাপাশি চলবে; অর্থাৎ কিছু শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম ও অন্যান্য শ্রেণিতে পুরনো শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পাঠদান কার্যক্রম চলবে। সেটিও স্কুল, শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকসহ সবার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই আমূল পরিবর্তিত শিক্ষাক্রম বিশেষ করে মূল্যায়ন পরিচালনার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের ব্যাপক প্রস্তুতি দরকার। শিখনকালীন মূল্যায়নে শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানের দায় অনেক বেশি। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী ফিডব্যাক প্রদান, রিপোর্টিং, ফলাফল সংরক্ষণ সর্বোপরি মূল্যায়নে নিরপেক্ষতার বিষয়টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ হবে। প্রতিষ্ঠান বিশেষত শিক্ষকের মান, দক্ষতা ও নৈতিকতার যথেষ্ট উন্নয়ন ছাড়া এই ব্যাপক পরিকল্পনার বাস্তবায়ন অসম্ভব বলেই মনে হয়। এই প্রস্তুতি কি ২০২২ সালের আগে এত কম সময়ে নেওয়া যাবে?

এছাড়াও শিক্ষানীতি ২০১০-এ যেসব নতুনত্ব ও পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়েছিল তার অনেক কিছুই এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। প্রাথমিকের মেয়াদ বৃদ্ধি, পিএসসি-জেএসসি পরীক্ষা বাতিলসহ গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনাগুলো কেন বাস্তবায়ন করা যায়নি সে সম্পর্কে গবেষণার প্রয়োজন ছিল। সে গবেষণা থেকে প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করতে পারলে নতুন পরিকল্পনায় তার প্রতিফলন থাকতে পারত। এতে ব্যর্থতার পরিমাণ কমে আসতে পারত। নতুন যেকোনো পরিবর্তন বড় পরিসরে বাস্তবায়নের আগে ছোট পরিসরে পাইলটিং করলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কমে। চলমান শিক্ষাবর্ষে কিছু স্কুলে পাইলটিং চলছিল বলে জেনেছি। কিন্তু এই শিক্ষাবর্ষে যেখানে করোনার কারণে পর্যাপ্ত ক্লাস হয়নি সে পরিস্থিতিতে অসমাপ্ত পাইলটিংয়ের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে কি? সর্বোপরি একথা স্বীকার করতেই হবে নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় অসংখ্য ভালো ধারণা ও বিষয় সংযোজিত হয়েছে। তবে এটি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষকসহ শিক্ষার সঙ্গে জড়িত সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর দক্ষতা, মানসিকতা ও নৈতিকতার ব্যাপক উন্নয়ন না হলে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন অসম্ভব। অভিভাবক ও শিক্ষার্থীসহ শিক্ষার সব অংশীজনের মানসিকতার পরিবর্তনও গুরুত্বপূর্ণ। এত কম সময়ে এত উচ্চাভিলাষী পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টা যদি কার্যকর পরিকল্পনার অভাবে সফল হতে না পারে তবে কারও লাভ হবে না। ভালো পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জগুলো বুঝে অর্জন উপযোগী পরিকল্পনা করলে ভালো হবে বলে মনে করি। প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমের রূপরেখাকে সামনে রেখে শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব অংশীদারের দক্ষতা, মান, মানসিকতা ও নৈতিকতার পরিবর্তন আনয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সক্ষমতা অনুযায়ী ধীরে ধীরে এগোলে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকৃত উন্নয়ন হবে।